জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির রায় ঘিরে রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এই রায় ঘোষণা করবেন।
এর মধ্য দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের প্রথম কোনো মামলায় বিচারের রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে। মামলার অপর দুই আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের সাবেক আইজিপি।
রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। হাইকোর্ট ও ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নেওয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রাজধানীর দোয়েল চত্বর থেকে শিক্ষাভবন অভিমুখী সড়কে যানচলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের চার দিক কড়া নিরাপত্তায় মোড়ানো হয়েছে। গেটের সামনে সেনাবাহিনীকে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে ও ভেতরে পুলিশ র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
এছাড়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, কারওয়ানবাজার রেলক্রসিং, মিরপুর, শাহবাগ, মগবাজার, গাবতলীতে পুলিশ সদস্যদের দেখা গেছে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি করতে।
তবে রাজধানীতে অফিসগামী ও সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক চলাচল দেখা গেছে। সড়কে রয়েছে যানবাহনের ভিড়, চলছে গণপরিবহন ও মেট্রোরেল। পুলিশ বলছে, যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে মাঠে রয়েছে পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা
এদিকে আজ রায় সরসারি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) বিটিভি ও বার্তাসংস্থা রয়টার্স। এছাড়া, ট্রাইব্যুনালের ফেসবুক পেজ থেকেও সরাসরি দেখানো হবে। পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে বড় স্ক্রিনে লাইভ সম্প্রচারের আয়োজন করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, হাসিনা-কামালের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডের প্রত্যাশা করছে তারা।
রায়ে স্বচ্ছতা দাবি মির্জা ফখরুলের
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে রায়ে স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রোববার বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এই দাবি জানান।
বিএনপি মহাসচিব লেখেন, সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছে, যেখানে গত বছরের ঢাকায় সংঘটিত প্রাণঘাতী সহিংসতা ও দমনপীড়নের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। আমরা পূর্ণ ন্যায়বিচার দাবি করছি।
প্রসিকিউশনের বক্তব্য
অভিযুক্তরা দণ্ডিত হলে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ভিকটিমদের পরিবারগুলোর মধ্যে বণ্টনের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ আবেদন জানিয়েছেন প্রসিকিউশন। গতকাল রোববার প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইনের বিধান অনুযায়ীই এই আবেদন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, যেহেতু আইনে রয়েছে, তাই আমরা দোষীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আবেদন করেছি। ন্যায়বিচারের স্বার্থে ট্রাইব্যুনাল যে আদেশ দেবেন, প্রসিকিউশন তা মেনে নেবে।
প্রসিকিউটর আরও জানান, এই মামলায় শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছে। প্রসিকিউশন বিশ্বাস করেন, এ মামলায় আনা পাঁচটি অভিযোগই তারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাকে নারী হিসেবে কোনো রকমের সহানুভূতি বা বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে না।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল খালাস পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি বলেন, আমার প্রত্যাশা, আমার মক্কেলরা খালাস পাবেন।
মামলার বিচার কার্যক্রম
চলতি বছর ১০ জুলাই অভিযোগ (চার্জ) গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকাজ শুরু হয় এবং ২৩ অক্টোবর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। গত বছর ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অভিযোগ গঠনের পর থেকে তিন মাস ১৩ দিনের মধ্যে বিচার শেষ হলো।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার
২০১০ সালের মার্চে স্থাপিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেখানে এ পর্যন্ত একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের মধ্যে ১৮৮ জনের বিরুদ্ধে করা মামলায় গত ১৪ বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে ৫৬টি রায় হয়। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত ১৫৫ আসামির মধ্যে ১০৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের (ফাঁসি) রায় হয়। আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে ২৫ জনের, ১২ জনের যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে ১২ আসামির। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক ৬২ জন।
এর মধ্যে জামায়াতের সাবেক আমির প্রয়াত অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচার শেষ হয়েছিল প্রায় ১০ মাসে। ২০১২ সালের ১৩ মে গোলাম আযমের মামলার অভিযোগ গঠন হয়। ১ জুলাই থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়ে ২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল বিচার শেষ হয়। এর পর দুই মাস ২৮ দিন পর ১৫ জুলাই রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল-১।
২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারের রায়ে জামায়াতের সাবেক রুকন পলাতক আবুল কালাম আযাদের (বাচ্চু) মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছিল। ২০১২ সালের ১৩ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর এক মাস ২২ দিন (৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২৬ ডিসেম্বর) শুনানি শেষে রায় দেওয়া হয়।
একনজরে শেখ হাসিনার বিচার
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গত বছরের ১৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ করেন শহীদ সিয়ামের বাবা বুলবুল ফকির। এতে প্রথম অভিযোগ ছিল শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, এক থেকে ৯ নম্বর আসামির নির্দেশে ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা দেশি এবং আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করে মামলা হিসেবে ট্রাইব্যুনালের ‘কমপ্লেইনার’ রেজিস্টারে নথিভুক্ত করা হয়। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
এরপর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয় গত বছরের ১৭ অক্টোবর। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর ১৬ মার্চ সাবেক আইজিপি মামুনকে এ মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা চলতি বছরের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। আর প্রসিকিউশন শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গত ১ জুন। প্রসিকিউশনের দাখিল করা অভিযোগপত্রটি ছিল ১৩৫ পৃষ্ঠার। এর সঙ্গে আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার বিভিন্ন নথি ও তথ্যপ্রমাণ জমা দেওয়া হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার জানে আলম খান ও মো. আলমগীর।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান দমনে এক হাজার ৪০০ জনকে হত্যা ও ২৫ হাজার মানুষকে অঙ্গহানির উস্কানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’সহ মোট পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলার বিচার শুরু হয়। উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২৩ অক্টোবর শেষ হয় মামলার বিচার। চলতি বছর গত ২ জুলাই আদালত অবমাননার দায়ে শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন একই ট্রাইব্যুনাল।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যা বললেন
গতকাল বরিশালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় যা-ই হোক না কেন, তা কার্যকর হবে। এ নিয়ে দেশে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলে তা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
